মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ওষুধসহ অন্যান্য মালামাল সরবরাহে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে গুরুত্বপূর্ণ এসব মালামালের সরবরাহ থাকলেও নেই বাস্তবে। এতে একদিকে যেমন জনগণ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি গচ্ছা যাচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে- মালামাল সরবরাহের কাজে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চালানো এক অভিযান সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ বছর মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মালামাল সরবরাহের কাজ পেয়েছে একই পরিবারের দুই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে— তাদের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়েছে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মালামাল সরবরাহের কাজ। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ২১৬ টাকার মালামাল সরবরাহ করা হয়। মেসার্স তাসিন এন্টারন্যাশনাল ও মিজান ট্রেডিং কোং নামে দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই কাজ পায়। যার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সিরাজুল আলম খান এবং অন্যটির মিজান খান। তারা দুজনেই আপন ভাই।

জানা গেছে, সিরাজুল আলম খান মাদারীপুর পৌরসভার কাউন্সিলর এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মালমাল সরবরাহ করা হয় ৪ কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ১১৯ টাকার। যা দুই ভাইয়ের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করে। ২০২০-২১ অর্থ বছরেও ওই দুই প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৩৫৭ টাকার মালামাল সরবরাহ করে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে মিজান ট্রেডিং কোং ৬ কোটি ৯ লাখ ৭১ হাজার ১২১ টাকার মালামাল সরবরাহ করে। মাদারীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরে ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করে। হাসপাতালের মালামাল সরবরাহের জন্য ৬টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৬টি প্যাকেজে ৯৮টি শিডিউল বিক্রি হয়। জমা পড়ে মাত্র ১৩টি শিডিউল। চলতি অর্থ বছরেও সবাইকে অবাক করে কাজ পেয়ে যায় সেই দুই ভাইয়ের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মিজান ট্রেডিং এবং তাসিন ইন্টারন্যাশনাল।

বরাদ্দকৃত ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার ‘ক’ গ্রুপের ইডিসিএল বহির্ভূত ওষুধ সামগ্রী ক্রয়ের জন্য ২৫ শতাংশ বরাদ্দ। ‘খ’ গ্রুপের সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ১২ শতাংশ, ‘গ’ গ্রুপে লিলেন সামগ্রী ক্রয় ৫ শতাংশ, ‘ঘ’ গ্রুপে গজ ব্যান্ডেজ ক্রয় ৫ শতাংশ, ‘ঙ’ গ্রুপে কেমিক্যাল ও রিএজেন্ট ক্রয় ৩ শতাংশ এবং ‘চ’ গ্রুপে আসবাবপত্র ক্রয় ৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত অর্থ বছরের গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৫ টাকা। লিলেন কাপড়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৯৪০ টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ও লিলেন কাপড়ের জন্য খরচ হয়েছে ১৯ হাজার টাকা। অথচ প্রতিদিন রোগীদের নিজ খরচেই কিনতে হয় এইসব সামগ্রী। ১০০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালের জন্য গত অর্থ বছরে আইভি ফ্লুইড ও দন্ত চিকিৎসার উপকরণ (ওষুধ) কেনা হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৩১ হাজার ১৮৪ টাকার। অথচ দন্ত চিকিৎসক নেই দুই বছর ধরে।

দন্ত চিকিৎসক না থাকলেও বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে এই বিভাগে। এছাড়াও অন্যান্য ওষুধ কেনা হয়েছে ১ কোটি ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৯৭৩ টাকার। মাদারীপুরের পাঁচখোলা গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী মো. রাজ্জাক বলেন, আমাদের তো জ্বর আর গ্যাস্টিকের ওষুধ ছাড়া সবই কিনে নিতে হয়। হাসপাতাল থেকে বলে সাপ্লাই নেই। শুনি ওষুধ কেনায় কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু তেমন কোনো ওষুধ তো পাই না। তবে সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উভয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের দাবী নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তারা মালামাল সরবরাহের ঠিকাদারী কাজ করেন। কোনো ধরনের অনিয়মের সাথে জড়িত নয় বলেও দাবী করেন তারা।মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, আমি যতদূর জানি মাদারীপুর সদর হাসপাতালে যারা ওষুধ সাপ্লাইয়ের কাজ করেন।

তারা দুই তিন বছর নয়। গত দুই দশক ধরেই তারা হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী সাপ্লাই করেন। তারা হাসপাতালের ঠিকাদারী ব্যবসার একটি শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। যার জন্য সব সময়ই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এখানে দ্রুত স্বচ্ছতা আনার দাবী করছি।এব্যাপারে মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মুনীর আহমেদ বলেন, মালামাল সরবরাহের কাজে অনিয়ম নেই। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। দন্ত চিকিৎসক না থাকলেও এই খাতে কোটি টাকা খরচের ব্যাপারে তিনি বলেন ওই টাকা দিয়ে অন্যখাতে খরচ করা হয়েছে।