★অন্ধকারে সামরিক গবেষণা, নিরব দর্শক হয়ে থাকা এক রাষ্ট্র
স্বাধীনতার অর্ধশতক পার করেছে বাংলাদেশ। পঞ্চান্ন বছরে পা রাখা একটি রাষ্ট্রের জন্য এটি সময় ছিল আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যুগোপযোগী প্রযুক্তির বিকাশের, এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির হিসাব-নিকাশে শক্তিশালী অবস্থান তৈরির। কিন্তু বাস্তবতা হল, আজও বাংলাদেশ নিজস্ব কোনো রাডার সিস্টেম গড়ে তুলতে পারেনি। নেই নিজস্ব মিসাইল সিস্টেম, নেই সাইবার ডিফেন্স কমান্ড, নেই ড্রোন বা সামরিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যকর কোনো গবেষণা ইউনিট।
বিশ্ব যখন আধুনিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ তখনও 'নিন্দা প্রস্তাব' এবং 'রাজনৈতিক বিবৃতি'তেই আটকে। কোনো দেশ যদি আক্রমণ করে, আমরা কেবল প্রতিবাদ করতে পারব—প্রতিরোধ নয়। এমন এক পরিস্থিতি যখন বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চল আগ্রাসনের হুমকিতে, তখন আত্মরক্ষার এই ব্যর্থতা আমাদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে।
★বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সনদ উৎপাদনের কারখানা!
একটি দেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রধান চালিকাশক্তি তার বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা কার্যক্রম আজ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে গবেষণার চেয়ে ‘সনদ’ বেশি গুরুত্ব পায়। ইন্টার্নশিপ এখন কেবল সিল মারা, খাতা ঘাঁটা বা ফর্ম পূরণের মাধ্যমে শেষ হয়। তরুণ মেধাবীরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেয়ে প্রশাসনিক চাকরির ফর্ম ফিলাপ এবং বিসিএস পরীক্ষায় ব্যস্ত। গবেষণাগারগুলোতে এখন রকেট তৈরির স্বপ্ন নয়, বরং ভাঙা চেয়ারে বসে গবেষণাহীন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বুদ্ধি খোঁজা হয়।
শিক্ষার্থীরা জানেই না—মিসাইলের নকশা কীভাবে হয়, সাইবার প্রতিরক্ষা কোন প্রযুক্তিতে গড়ে উঠে, বা কীভাবে AI ব্যবহার করে দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা যায়। রাষ্ট্রও এ বিষয়ে উৎসাহ দেয় না। কারণ রাষ্ট্রের চোখে গবেষণা বাজেট এক ধরনের “অপ্রয়োজনীয় ব্যয়”।
★সরকারি পরিকল্পনার দৈন্যদশা
সরকারের দিক থেকেও সামরিক গবেষণাকে নিয়ে তেমন কোনো বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ দেখা যায়নি। একটি দেশের সামরিক খাত তখনই শক্তিশালী হয়, যখন সে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্ভর করতে পারে। অথচ বাংলাদেশ এখনও আমদানিনির্ভরতায় আবদ্ধ। কোটি কোটি টাকা দিয়ে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউক্রেন থেকে কেনা অস্ত্র দিয়ে কেবল বাহ্যিক কাঠামো গড়া গেলেও, তা স্থায়ী আত্মরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না।
রাডার, ড্রোন, মিসাইল, সাইবার প্রতিরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোন স্থায়ী গবেষণা কেন্দ্র, প্রযুক্তিগত ট্রেনিং ফ্যাসিলিটি বা স্টেট-স্পন্সরড ইউনিভার্সিটি প্রোগ্রাম গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র নিজের সামরিক প্রযুক্তি তৈরির ন্যূনতম সদিচ্ছাও দেখায়নি।
★আঞ্চলিক বাস্তবতায় আত্মনির্ভরতা অপরিহার্য
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা যেভাবে দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে, তাতে একটি নিরস্ত্র মানসিকতা নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভারত তার প্রতিরক্ষা গবেষণায় প্রতিনিয়ত বিপুল অর্থ বরাদ্দ করছে। চীন বিশ্বের সামরিক গবেষণায় অন্যতম নেতা। পাকিস্তান পর্যন্ত নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আত্মবিশ্বাসী অবস্থানে।
বাংলাদেশের উচিত এখনই একটি **জাতীয় সামরিক গবেষণা নীতি** (National Military Research Policy) তৈরি করা। যেখানে সেনাবাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বেসরকারি গবেষকগণ একসঙ্গে কাজ করবে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে। গবেষণার বাজেট বাড়াতে হবে বহুগুণ, তৈরি করতে হবে আলাদা সামরিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চ সেন্টার।
★মেধাবীদের সামরিক উদ্ভাবনে যুক্ত করুন
শুধু চাকরি নয়, দেশ গঠনে অংশ নেওয়ার একটি সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার। মেধাবীদের এমন সুযোগ দিতে হবে, যেখানে তারা ড্রোন প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর অস্ত্র, কিংবা সাইবার প্রতিরক্ষা নিয়ে গবেষণা করতে পারে। এর জন্য সরকারকে দিতে হবে স্কলারশিপ, গঠন করতে হবে প্রতিরক্ষা গবেষণা তহবিল, এবং অবশ্যই প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
স্মার্ট বাংলাদেশ তখনই সম্ভব, যখন সেই বাংলাদেশ নিজের প্রযুক্তিতে স্মার্ট হয়ে উঠবে। না হলে, ডিজিটাল কাগজে মেসেজ লেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না।