সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি কামিনী রায় নারীকল্যাণমূলক কাজেও আত্মনিয়োগ করেন। শেষ জীবনে তিনি ঢাকার হাজারীবাগে বাস করতেন।

‘করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে –
পাছে লোকে কিছু বলে।’… কামিনী রায়।

কবি কামিনী রায় একাধারে প্রথিতযশা সমাজকর্মী ও নারীবাদী লেখক ছিলেন। বেথুন কলেজ হতে তিনি ১৮৮৬ সালে ভারতের প্রথম নারী হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। কামিনী রায় ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের (বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলা) বাসন্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চন্ডীচরণ সেন ছিলেন একজন ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখক ও পেশায় বিচারক। কন্যা কামিনী রায়ের প্রাথমিক শিক্ষার ভার চণ্ডীচরণ সেন নিজে গ্রহণ করেন। বার বৎসর বয়সে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে বোর্ডিংয়ে প্রেরণ করেন। কামিনী রায় ১৮৮০ সালে কলকাতা বেথুন স্কুল হতে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) পরীক্ষা ও ১৮৮৩ সালে এফ.এ বা ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৬ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ১৮৮৬ সালেই তিনি বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে শিক্ষয়িত্রীর পদে নিযুক্ত হন। কামিনী রায়ের শৈশবের দিনগুলি ছিল অনেক সুন্দর। ছোটবেলায় তাঁর পিতামহ তাঁকে কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেন।

তাঁর মা গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। কারণ তখনকার যুগে হিন্দু নারীদের লেখাপড়া গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কামিনী রায় মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখের সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। ১৮৮৯ সালে কামিনী রায়ের পনেরো বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লেখেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কামিনী রায় এক সময় ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে লিখতেন। কামিনী রায়ের লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: আলো ও ছায়া (১৮৮৯), নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪), অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবন পথে (১৯৩০), একলব্য, দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন, শ্রাদ্ধিকী। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত 'মহাশ্বেতা' ও 'পুণ্ডরীক' তাঁর দু'টি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা।

এ ছাড়া ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন। তাঁর কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায়। পরবর্তীতে তিনি তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু ১৯০৯ সালে কামিনী রায়ের স্বামীর মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যু শোক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে, যা তাঁর কবিতায় প্রকাশ পায়। ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কামিনী রায়কে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' প্রদান করা হয়। কামিনী রায় নারীশ্রমিক তদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য (১৯২২-২৩), বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভানেত্রী (১৯৩০) এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি (১৯৩২-৩৩) ছিলেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি কামিনী রায় নারীকল্যাণমূলক কাজেও আত্মনিয়োগ করেন। শেষ জীবনে তিনি ঢাকার হাজারীবাগে বাস করতেন।