পঞ্চাশের দশকে যে ক’জন কথাশিল্পী জীবন ও সমাজকে পাশাপাশি রেখে সমাজবাস্তবতার অম্লমধুর গান গেয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কেননা শিল্পীমাত্রই সমাজজীবনের অনুসন্ধিৎসু দর্শক। সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচার, অনাচার, ব্যভিচার, জ্বালা-যন্ত্রণা, জীবনের উন্মত্ততা ও নগ্নতাকে পছন্দমতো শৈল্পিক উপাদানে কলমের আঁচড়ে সাহিত্যে তুলে ধরেন। তাঁর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি সামন্তবাদ ও বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলোকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে তাঁর গল্পের আলোকে বিষয়টি চিহ্নিত করার প্রয়াস পাব। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি। গ্রন্থগুলো হলো ‘সম্রাটের ছবি’ (১৯৫৯), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (১৯৬৬) ও ‘সুন্দর হে সুন্দর’ (১৯৬৭)।
‘সম্রাটের ছবি’ গল্পটি সামন্ততন্ত্রের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। এ গল্পে তৎকালীন জমিদারদের বৃটিশপ্রীতির এক অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছেন। সেইসঙ্গে দেশ স্বাধীনের পরও বৃটিশদের প্রতি তাদের অন্ধ প্রীতির আলেখ্য চিত্রিত করেছেন। গল্পের নায়ক যুবক জমিদার উমর আলী খান। তিনি বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য ও সাহায্য সহযোগিতার জন্য পেয়েছেন ‘খান বাহাদুর’ উপাধি। এর মধ্যে তার জীবন থেকে ঝরে পড়েছে চল্লিশটি বছর। তার সংসার বড় হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিলুপ্তি হয়েছে জমিদারি প্রথা। তবুও প্রাচীন ঐতিহ্যকে লালন করার জন্য তিনি বহন করছেন ‘সম্রাট জর্জ দ্য ফিফথ’ এর ছবি। সেগুন কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি দীর্ঘসময় পাড়ি দিলেও তার জৌলুস এখনো বিলুপ্ত হয়নি। খান বাহাদুর এখনো ছবিটিকে ঋষিতুল্য ভক্তি করেন।
অন্যদিকে তার ছেলে মনসুর সদরের তরুণ উকিল। জেলা জজের ছোট জামাই। মনসুরের স্ত্রী রিজিয়া আধুনিক শিক্ষা ও জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। মনসুর বৃটিশপ্রীতিকে উপেক্ষা করে সবার সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে। বৈঠকখানার সোফায় সাধারণ প্রজাদের বসবার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু খান বাহাদুর এসব সহ্য করতে পারেন না। তবুও ছেলের যুক্তির কাছে হার মানেন। আরও হার মানেন ছেলে ও বৌমার সুকৌশলে সামন্ততন্ত্রের আঁকড়ে ধরা শেষ চিহ্নটি উৎখাত করার সময়। তখন খান বাহাদুর রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তিনি আরও ক্ষুব্ধ হন চল্লিশ বছর আগে শয্যাগৃহে রাখা মহারাণী ভিক্টোরিয়ার যুবতী বয়সের ছবিটি সরানোর পর। মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষকে সহ্য করতে পারে না। তারপরও আবার যুবতী রাণী। এখানেই চরিত্রটির মনস্তাত্বিক দিকের পরিস্ফুটন ঘটেছে। গল্পটি রোমান্টিক আবহে নির্মিত একটি মধুর রসের গল্প। এখানে মানবজীবনের জটিলতাকে উন্মোচিত করে একটি জীবনতত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। সার্বিক বিচারে গল্পটি পাঠকনন্দিত হতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘নীল কমল’ গল্পে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত পরিবারের অভ্যন্তরীণ জীবন-জটিলতার বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এ পরিবারের সামন্ত প্রতিভূ শমসের আলী খান। একসময় তার জমিদারির জৌলুস ছিল। কালক্রমে তা নিঃশেষ হতে চলেছে। এর কারণ তার চরিত্রের স্খলন। সে চাঁদনী রাতে বজরায় গিয়ে রাত কাটায়। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স্কা কুলসুমের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এমনকি দ্বিতীয় স্ত্রী বেগম রিজিয়া বানুকে উপেক্ষা করে তার আবার নতুন বিয়ের পরিকল্পনা। মধ্যবয়সে উপনীত হয়েও শমসের আলীর পরিবারে কোনো সন্তান নেই। সন্তানহীনতার বেদনায় তাকে আবার বিয়েতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই সে পরিকল্পনার বৈরিতা নিয়ে ডাক্তারকে দিয়ে স্ত্রীকে পরীক্ষা করান। কিন্তু বিষয়টি আলাদা।
এগুলো তার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সন্তানহীনতার কারণ হলেও তিনি নতুন বিয়ে করার সিদ্ধান্তে অটল। ডাক্তার সাহেব বেগম রিজিয়া বানুর মা হওয়ার কোনো অন্তরায় না দেখে শমসের আলীকে পরীক্ষা করতে চান। কিন্তু শমসের আলী বাঁদী কুলসুমের গৌরবর্ণ পুত্রটিকে দেখিয়ে হেসে বলেন, এই ছেলেটি তারই ঔরসজাত সন্তান। সর্বোপরি ‘নীল কমল’ সম্পর্কে বলা যায়, লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতারই একটি জীবন্ত গল্পরূপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘নতুন গোধূলী’ একটি প্রেমের গল্প। এখানে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। গল্পের নায়ক জমির একজন খ্যাতিমান গায়ক। গানের নেশাই তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ঘুরতে ঘুরতে সে আশ্রয় পেয়েছে গল্পের নায়িকা হাসিনা বানুদের বাড়িতে। হাসিনা জমিরের কণ্ঠ পছন্দ করে, জমির পছন্দ করে হাসিনার রূপ ও সৌন্দর্য। দুজন দুজনকে ভালোবাসে। কিন্তু তাদের মিলনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় হাসিনার বাবা। সঙ্গত কারণেই তারা পাড়ি জমায় শহরে। কিন্তু গায়ক অবস্থায় জমিরের যে উদাসীনতা তা তাকে নতুনভাবে পেয়ে বসে। ধীরে ধীরে তার গলা বসে যেতে শুরু করে এবং শরীর ভেঙে পড়ে। জমির ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারে তার গান ছেড়ে দিতে হবে এবং পুরোপুরি অবসরে থাকতে হবে। তারপর থেকেই শুরু হয় হাসিনার প্রতি তার উদাসীনতা। কারণ জমির জানে হাসিনা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং জমিরই তার একমাত্র ভরসা। এ জন্যই জমির টিউশনির উসিলা করে সারাদিন বাইরে থাকে। কেউ টিউশনির জন্য এলে তাকে নানা টালবাহানায় ফিরিয়ে দেয়। হাসিনাকে ভুলে থাকার জন্য সে মদপান করে। হাসিনা বাধা দিলে তাকে প্রহার করে। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক মুহূর্তেও তাকে সোহাগ থেকে বঞ্চিত করে।
এভাবেই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জ্বলতে থাকে জমির। জীবনে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে সে এখনো টিকে আছে। শেষ পর্যন্ত তার জীবনের ট্রাজিক পরিণতি দেখা যায়। গল্পকার গল্পের শেষ পরিণতি টানার জন্য প্রথম থেকেই উত্তমপুরুষের চরিত্র আমদানি করেছেন। সে ‘আমি’র বদান্যতায় জমিরের চিকিৎসা হয়। আর হাসিনা বানু খুঁজে পায় এক নির্ভরতার প্রতীককে। জমির ভালো হয়ে ওঠে এবং এর ছয় মাস পরেই আকস্মিকভাবে তার জীবনের ইতি ঘটে। তার প্রিয়তমা স্ত্রী হাসিনা বানু এতদিন যে আশা খুঁজেছিল তার বুকের ভেতরে আজ সে পাথরের মূর্তির মতো হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকে। তার নির্ভরতা ও আশ্রয় আজ কোথায়? সর্বোপরি, গল্পটি মানবজীবনের জীবন-জটিলতার বাস্তব আলেখ্য। শুধু সে সময়েই নয়, আজও আমাদের সমাজে অহরহ ঘটে যাচ্ছে এ ধরনের বাস্তব ঘটনা। যা আমাদের চারপাশের জীবনধারার সঙ্গে একিভূত হয় বৈকি।
‘অন্য কোনখানে’ নাগরিক জীবনের জটিলতার গল্প। নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ অভাব-অনটনে পড়ে কীভাবে চরিত্রের স্খলন ঘটান এবং সমাজের উচ্চশ্রেণিতে পরিণত হন তার এক বাস্তব চিত্র এ গল্পে ফুটে উঠেছে। এ গল্পের নায়িকা মিস নীলিমা নাসরিন। সে গ্রাম্য সহজ-সরল বিএ ফেল যুবকের স্ত্রী। চাটগাঁর লাভ লেনের ভাঙাবাড়িতে তারা বসবাস করত। স্বামীর টাকা নেই মূলধন নেই। স্বামীর কারণেই এই ভাঙাবাড়ির সামনে মাঝে মাঝেই মোটর এসে দাঁড়াত। ধনাঢ্য মানুষের আগমন ঘটতো। কিন্তু নীলিমা এসবে প্রবল আপত্তি করতো, বাধা দিত এবং নিরুপায় হয়ে কান্নাকাটি করতো। অথচ তাঁর স্বামী অনড়। কারণ নীলিমা তার বিয়ে করা বউ। বউয়ের উপর তার যথেচ্ছার অধিকার রয়েছে। এই অধিকারকে পুঁজি করে নিজের বউকে বাধ্য করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গ দিতে, তাদের মনোরঞ্জন করতে। অবশেষে স্বামীর অনৈতিকতা ও অপইচ্ছার কাছে হেরে নীলিমা গ্রাম্যবধূর পোশাক খুলে আধুনিকা হয়ে ওঠে। আর এর পেছনে ইন্ধন জোগায় জোয়ারদার। ঠিক দশ বছরে নীলিমা মোহনীয় ও ধনবতী নারীতে পরিণত হয়। বর্তমানে সে কসমোপলিটান ট্রেডার্সের সেক্রেটারি। তারই স্বামী আশরাফ আলম তার হেড ক্লার্ক। স্বামীর সামনেই সে ইভনিং রিক্রিয়েশন করার জন্য ওভারসিজ এজেন্সির ডিরেক্টর মি. ডানকান, নজফ খোরাসানি, গ্রীন হিলের জোয়ারদারকে ডাকেন। এ সমস্ত ঘটনায় আশরাফ আলম মলিন বিমর্ষতায় কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন।
অফিসের জুনিয়র টাইপিস্ট মেঞ্জিসের স্বভাব বউ পাল্টানো। তার দ্বিতীয় বউ তাকে ডিভোর্স দিয়েছে একথা অফিসে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করে। নীলিমা নাসরিন আশরাফ আলমকে ডাকার আগেই সে হাজির হয়ে পদত্যাগপত্র দিয়েছে। আশরাফ আলম নির্ভয়ে স্ত্রীর মতো সম্বোধন করে কথা বলেছে। তারপর সে বিবর্ণ ও বিমর্ষ বেশে নয় স্বহাস্য ও জীবন্ত বেশে কামরা থেকে বের হয়ে এসেছে। তারপর থেকেই নীলিমা স্বাভাবিক থাকতে পারেননি। দশ বছর আগের স্মৃতি তার ভেসে ওঠে। সমাজের এ দুর্বৃত্তদের প্রতি তার ঘৃণা নিক্ষিপ্ত হয়। স্বামীর ছবিটিতে আগুন ধরিয়ে অ্যাসট্রেতে গুঁজে দেন। ছটফট করে ওঠে তার মনপ্রাণ। ঘামতে থাকেন অবিরত। হঠাৎ সকালে হাউমাউ করে দরজায় আঁছড়ে পড়ে মেঞ্জিস। কারণ তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে আশরাফ আলম পালিয়েছে। সর্বোপরি গল্পটিতে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ ও নাগরিক সভ্যতার জীবন-জটিলতার বাস্তব আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। গল্পকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নগরজীবনে ঘটে যাওয়া অসঙ্গতিগুলোকে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
‘আদিম’ মূলত সামাজিক প্রেমের গল্প। জেলেকন্যা লক্ষ্মীকে ঘিরেই এর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এ গল্পে ইলশার বুকে জেলেদের জীবনযুদ্ধ, সোনাকান্দি গ্রামের মানুষদের জীবন-জীবিকা-সংগ্রাম, আর্থ-সামাজিক, সে সঙ্গে সুন্দর তরুণী-বধূ লক্ষ্মীকে ঘিরে বংশীর প্রেম-ঈষা-হিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতা এবং সোনাকান্দির বিত্তশালী মনসুর তালুকদারের প্রেমার্তি পাঠকের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।
নারী নিজের শরীরী সৌন্দর্য ও চোখের জাদু পুরুষের চোখে-মনে ছড়িয়ে আদিম প্রবৃত্তির নেশা জাগিয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার যে চেষ্টা এটিই এই গল্পের প্রধান দিক। গল্পটিতে জীবন সংগ্রামের এক অনবদ্য চিত্র পাওয়া যায়। দরিদ্র রূপসী নারীর অসহায়ত্বকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা ধনীশ্রেণির স্বভাবজাত, আর এই অন্যায় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার কারণে অসংখ্য মানুষের জীবনে কতোটা ভয়াবহ ক্ষতি নেমে আসে, আবার জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য জেলে কন্যা রূপবতী লক্ষ্মীর বিভিন্ন ধরনের ছলাকলার আশ্রয় গ্রহণ, প্রেমে ব্যর্থ বংশীর ঈর্ষা, প্রতিশোধ পরায়ণতা গল্পটির বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
‘কুমকুম’ গল্পে আমরা দেখি, গল্পটির নায়িকা কুমকুম তার পাড়া-মহল্লায় সবার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠলেও সবার থেকে সে আলাদা, কথাবার্তায় চালচলনে স্বাধীনচেতা স্বভাবের। পাড়া-মহল্লায় সে দুমুর্খ বলে পরিচিত, আবার তার রূপের খ্যাতিও যথেষ্ট। তার সাহস, স্পষ্টবাদিতাকে পাড়ার বখাটে-মাস্তান ছেলেরা ভয় পায়। আবার প্রেমেও সে নিঃসঙ্কোচ, স্পষ্টবাদী। নারীদের সমাজের শেকল ভেঙে নিজস্ব অধিকার বোধে সচেতনতা এবং প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশে দ্বিধাহীন নিসঙ্কোচ সাহসিক একটি চিত্র আমরা পাই। সময়ের প্রেক্ষিতে যা একটি সাহসী উচ্চারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সময়ের প্রেক্ষাপটেও কুমকুম বাঙালি নির্যাতিত নারী সমাজের প্রতিবাদী এক চরিত্রই শুধু নয়, প্রতিনিধিও।
কুমকুম এ সমাজের সাহসী নারী মুখ। জীর্ণতা ভেঙে, গতানুগতিকতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে, সামাজিক সংকীর্ণতা দুপায়ে মাড়িয়ে এই সমাজের বুকেই প্রেমে-সাহসে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় সঙ্কোচ-দ্বিধাকে পিষে, নিজের অধিকার-ভালোবাসায় তখন উজ্জ্বল এক নারী স্মারক হয়ে ওঠে। আর এখানেই একজন কুমকুম সাধারণ থেকে অসাধারণ ও অনন্য হয়ে উঠেছে। কুমকুম যেভাবে নষ্ট সমাজচক্ষুর মাঝে দাঁড়িয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে আমিনের হাত ধরে তা এই সমাজের অবরুদ্ধতা ভেঙে নারীকে খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসার একটি সাহসী উচ্চারণ হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। ফলে এটি চমৎকার একটি প্রেমের গল্প হয়েও ব্যাপক অর্থে ভিন্ন ব্যঞ্জনা ও গুরুত্ব বহন করে।
গল্পকারের সযত্নসৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক একটি গল্প ‘রুচিরা’। গল্পটিতে পাশাপাশি ফ্ল্যাট বসবাসরত দুটি পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত নানান বিষয় বিশেষ করে তাদের রুচিশীলতার বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। এ গল্পে নারী চরিত্রের রহস্যময় জটিল একটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। ভালোবেসে বিয়ে করে শারীরিক সম্পর্ককে যে নারী স্থূলতা মনে করেছে, যে গান তার কাছে অশ্লীল মনে হয়েছে, শত চেষ্টা-কৌশল-চিকিৎসা তাকে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে স্বাভাবিক ভাবাতে পারেনি-সেই নারীই আবার অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঘটনার মধ্য দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, রুচির ধরন বদলায়, চেহারা-সুরতে ফুটে ওঠে তৃপ্ততার আভা। নারী চরিত্রে এক জটিল দিক এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেইসঙ্গে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বসবাসরত দুটি পরিবারের সামাজিক, আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক একাত্মা হৃদয়বন্ধন তৈরির বিষয়টিও গল্পটির বিষয়বস্তুতে শুধু চমকপ্রদতাই তৈরি করে না-তাৎপর্যতাও বহন করে। আর এ গল্পের মানব-মানবীর জৈবিক প্রবৃত্তি চিরন্তন এ সত্য বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকৃতিগত এই চিরন্তন সত্যটিকে জোর করে অস্বীকার করা যায় না- জীবনের সিঁড়িতে সহজাত আদিম এই প্রবৃত্তি কখনো না কখনো জড়িয়ে যাবেই। আর এটিও সুন্দরেরই এক অনবদ্য রূপ। এই সুন্দরতাই মন-শরীরে বিকশিত হয়ে ওঠে তৃপ্ততার আলো রূপে। মনস্তাত্ত্বিক শৈল্পিকতায় এই জটিল বিষয়বস্তু ‘রুচিরা’ গল্পে চিহ্নিত হয়েছে।
‘চেহারা’ গল্পে সমাজের ক্ষত তুলে ধরার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। সুদর্শনা নারী সমাজে কোনো কালেই যে নিরাপদ নয়- পদে পদে তাদের জন্য বিপদ যে ওৎ পেতে থাকে এবং একটি মাত্র অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জীবনকে কীভাবে বদলে দিতে পারে- কীভাবে আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সৌধ ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে, কীভাবে পারিবারিক সম্মান-খ্যাতিতে আকস্মিক বজ্রাঘাতের মতো কলঙ্ককালিমা লেপন হয়ে সমাজজীবনে কতোটা বিব্রত অবস্থা সৃষ্টি করে- এসবই আলোচ্য গল্পে মূল উপজীব্য।
গল্পে আশরাফ খান সানুর শ্লীলতাহানির ঘটনাটি গোপন করে একরকম তাড়াহুড়ো করে দ্রুতই তাকে পাত্রস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন। এমএ পাস পাত্র পেয়ে তার সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনেই শুধু শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে মেয়েকে পাত্রস্থ করেন। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর বর-কনেকে পর্দায় ঘিরে আয়নায় পরস্পরের মুখ দর্শনের সময় সানু বরের মুখ দেখামাত্রই ভয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারায়। সুবেশি সুশিক্ষিত চেহারা, ভদ্র-মার্জিত, চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপসম্পন্ন এই শিক্ষিত বর স্বরূপ পুরুষটির বাহ্যিক চেহারার আড়ালে যে তার আর একটি ভয়াবহ অন্ধকার দিক আছে- যে অন্ধকারের ভয়াল থাবার শিকার সানু নিজেই। তার মুখ আয়নায় দর্শন করা মাত্রই অতীতের ভয়ংকর ঘটনাটি তার মনে পড়ে এবং সে চিৎকার দিয়ে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডা. চৌধুরীরর চেষ্টায় স্বল্পসময়ে সে আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। গল্পটিতে একজন মেয়ের সুন্দর চেহারা যেমন তার বিপদের জন্য সহায়ক, তেমনই আর একশ্রেণির পুরুষ আছে যারা বাইরে ভদ্র-মার্জিত শিক্ষিত, ভেতরে নারীলোভী। সমাজচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে নৈতিক স্খলিত এ ধরনের পুরুষেরা সমাজে সভ্য ও ভদ্রতার লেবাস পরে অসংখ্য ও অমার্জনীয় ক্ষত তৈরি করে- লেখক খুব দক্ষতার সঙ্গে সমাজের ভয়াবহ এসব ‘চেহারা’ তুলে ধরতে পেরেছেন। ‘চেহারা’ গল্পে মূলত সমাজের কালো দিকগুলোই শৈল্পিক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে।
‘দুই শরিক’ গল্পের বিষয়বস্তু একেবারেই আমাদের চেনা-জানা। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনচিত্র, স্ত্রীদের বংশ-অহমিকা, সম্পদের প্রতি লোভ-লালসা, স্ত্রীর পরামর্শ-প্ররোচনায় ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার, সহজ-সরল উপায়ে শঠতাবাণিজ্য- এ গল্পের উপজীব্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে। গ্রামীণ সমাজে পরিবারে বহুকাল আগে থেকেই এসব সমস্যা চলে আসছে। এখনো আছে। শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে সমাজব্যবস্থায় আধুনাকয়ন ঘটলেও সমাজচক্ষুর আড়ালে কখনো প্রত্যক্ষভাবেই এসব সমস্যা বিরাজিত। গল্পটির বিষয়বস্তুতে কোনো নতুনত্ব না থাকলেও লেখকের ভাষা আর উপস্থাপনাশৈলীগুণে গল্পটি পাঠকের মনোযোগ কাড়ে। লেখকের আরেকটি কৃতিত্ব হলো গল্পটি ইয়াসিন ও ইউসুফ নামের দুই সহোদর অর্থাৎ একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা একটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। একটা বৃহৎ সমাজব্যবস্থাকে আঁকরভাবে ধারণ করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, সে সঙ্গে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত সমস্যাগুলোকে তিনি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন। আবার এভাবেও বলা যায়, গল্পটিতে একটি সময়কে ধারণ করা হয়েছে, যে সময়ে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারগুলোতে সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা, নিজস্ব প্রভাব ও ক্ষমতাগিরি দেখানোর যে অসুস্থ মানসিকতা তৈরি হয়েছিল সেটিই মূলত ‘দুই শরিক’ গল্পটির মূল বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে।
‘কৃষ্ণপক্ষ’ প্রেমের গল্প। সহেলি আর রিজভির প্রেমকে কেন্দ্র করে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ গল্পের কাহিনি তৈরি হলেও প্রয়োজনে আরও অনেক চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। সহেলি ও রিজভি একে অপরকে ভালোবাসলেও বাস্তবে দুজনের কেউই কাউকে পায়নি। জীবন চলার পথে সহেলি স্বামীকে হারিয়েছে, রিজভি হারিয়েছে স্ত্রীকে। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে মধ্যবয়সে এসে দুজনেই আবার একা। সহেলি একটি স্কুলের শিক্ষক। চমৎকার পরিবেশে বহুদিন পর দুজনের দেখা হয়। দুজনই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটায় মমতাজের ছবি। সহেলি ট্রাজিক এক কাহিনি রিজভিকে শোনায়। রেস্ট হাউসের একটা রুমে শোভাবর্ধন করছে একটি গ্রিক ভাস্কর্য। শরীরে সুশোভিত একটি বাঙালি মেয়ের তৈলচিত্র। নিচে নাম লেখা: বেগম সুরাতুন্নেসা ফখর বানু। ট্রাজিক এ কাহিনির প্রসঙ্গ এখান থেকেই ওঠে। ফখর বানুর জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পায় সহেলি। সহেলি ও রিজভির কাহিনির মূলস্রোতে ফখর বানু সংযোজিত হয়ে কাহিনির গতিকে ও বিষয়বস্তুকে আরও অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণতা দান করেছে। ব্যর্থ প্রেমের একটি গল্প হিসেবেই ‘কৃষ্ণপক্ষ’কে চিহ্নিত করা যায়।
কুলিদের বেদনার্ত জীবনচিত্র ‘বৃত্ত’ গল্পটির মূল উপজীব্য। গল্পটিতে কুলিরা অমানবিক পরিশ্রম করে যা আয় করে তার একটা মোটা অংশ কুলি সর্দারের জন্য জমা বরাদ্দ থাকে। অথচ কুলি সর্দার সাধারণ কুলিদের কোনো সহযোগিতা করে না, কোনো সহানুভূতিও দেখায় না। বরং তাদের উপর যখন তখন অত্যাচারের স্টিম রোলার চালায়। কুলিদের দৈনন্দিন জীবনচিত্র গল্পটিতে অত্যন্ত দরদের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন লেখক। ‘বৃত্ত’ গল্পটিতে কুলিদের দৈনন্দিন জীবনচিত্রই মূল বিষয় হিসেবে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। তবে শ্রেণিবৈষম্য বা শ্রেণিদ্বন্দ্ব- এ গল্পের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
‘ত্রিযামা’ গল্পে সমাজজীবনে বসবাসরত নানান প্রকৃতির লোকের দোষ-ত্রুটি-হিংসাদ্বেষ, অপকৌশল কার্যসিদ্ধি করার চেষ্টা বর্ণিত হলেও এর মূল বিষয় প্রেম। মিজান ভুঁইয়ার মেয়ে রোশনার প্রতি জহির চৌকিদারের দুর্বলতা এবং তাকে পাবার জন্য সে বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়ে। রোশনাকে পাবার জন্য সৈন্যদলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও, বাস্তবে তা হয়নি, হয়েছে চৌকিদার- যার কাজ হলো চোর-ছ্যাঁচোড়কে ধরা, পিটুনি দেওয়া। মানসিকভাবে এ চাকরি সে পছন্দ না করলেও মায়ের কান্নাকাটির কারণে চৌকিদারি গ্রহণ করে। কিন্তু এসবের পরেও গল্পে যা প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে তা হলো রোশনাকে পাবার জন্য তার একটির পর একটি অন্যায়, অপকর্ম ও ষড়যন্ত্র। আর এসবের শুরু হয় যখন রোশনার বাবা মিজান ভূঁইয়া তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সর্বোপরি সমাজজীবনের নানা অসঙ্গতি গল্পটির বিষয়বস্তু হিসেবে স্থান পেলেও একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্প হিসেবেই এটির গুরুত্ব অধিক।
‘জইতুন’ গল্পে সমাজের নিকৃষ্ট একশ্রেণির চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। সাদাসিধে স্বভাবের সুরুয সাধারণ এক জিলিপি বিক্রেতা। সততা ও আদর্শ মেনে তার জীবন। কোনো অন্যায়, অসততা, মিথ্যাচারিতা তার মধ্যে নেই। স্বল্পভাষী সুরুয নিয়মকানুন মেনে সামাজিকভাবে জইতুনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। চেরাগ মিজির মাধ্যমে। মিজি আশঙ্কা করে জইতুনের সঙ্গে সুরুযের বিয়ে তেমন কঠিন না হলেও বয়োষর্দ্ধো জলিল সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ জলিল জইতুনকে চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে পেতে বদ্ধপরিকর। জলিলকে যখন সুরুযের বিষয়টি জানানো হলো তখন সে বাধা দেয় না। বরং ‘খুশি মনে আরো পঁচিশ’ টাকা ঋণ দেয় সুরুযকে। কিন্তু এর বিনিময়ে একটা চিরকুটে সুরুযের টিপসই নিয়ে রাখে। মনে মনে ভাবে সুরুযকে একসময় সর্বশান্ত করে জইতুনকে তালাক দিতে বাধ্য করবে এবং এরপর সে জইতুনকে বিয়ে করবে।
জলিলের চক্রান্ত অনুযায়ী সুরুযের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। সুরুয এতে অবাক হয়। জলিল সুরুযের কাছে জইতুনকে তালাক দেওয়ার প্রস্তাব দিলে রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় সে জলিলের গালে কষে এক চড় মারে। তারপর ঘরে ফিরে যখন জইতুনকে বলতে শোনে ‘দোহাই তোমার, ক্যান আমার লাইগ্যা মান-সম্মান, বাড়ি-ঘর, জোত-জমি হারাইবা’ তখন দুঃখ-কষ্টে জইতুনের গালেও কষে চড় মারে। এরপর সুরুযের দুচোখ পানিতে ভরে ওঠে। আর সে চোখে তখন ‘দুঃসহ ক্রোধ, তিক্ত ঘৃণা, নিদারুণ বেদনার ম্লান ছায়া’। সমাজে জলিলের মতো নষ্ট মানুষেরা ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিভিন্ন চক্রান্তের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যে কত রকম বিপদ সমস্যা ও অসম্মানের মধ্যে ঠেলে দেয় এবং মানসম্মান, বাড়িঘর, জোত-জমি এসবের থেকেও সুরুযের মত মানুষের কাছে স্ত্রীই বড়- এ দুটি দিক গল্পের প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে সমাজের একশ্রেণির মানুষের নোংরা কর্মকাণ্ডের ফলে সাধারণ মানুষেরা কীভাবে ভোগান্তির শিকার হয় তা উপস্থাপিত হয়েছে।
‘সুন্দর হে সুন্দর’ গল্পটি বাঙালি জীবনের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অম্লমধুর বাস্তবের আলেখ্য। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ওতপ্রেতাভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করা যায় না। বাঙালি জীবনে বিষয়টি একই সুতোয় বাঁধা। তাই সুখ ভোগ করতে গেলে দুঃখ-কষ্ট তার জীবনে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে গেলে অসুন্দরও তেমনি দানা বেঁধে ওঠে। অমসৃণ পথে পা বাড়ানোর চিত্র উন্মোচন করে সমাজ-বাস্তবতার এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। মানুষ জীবন ও জীবিকাকে সুন্দর ও মসৃণ করে তুলতে চায়। তাই সামাজিক প্রতিকূলতায় প্রতিনিয়ত তাদের সংগ্রাম করতে হয়। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য বেছে নিতে হয় অসুন্দরের পথ। সর্বোপরি বলতে হয়, গল্পটিতে নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের জীবন প্রণালির বিচিত্রতা এবং জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনের জটিল আবহ চিত্রিত।
ছা-পোষা সমাজের প্রতিনিধি আমাদের দরিদ্র শিক্ষকসমাজ। এই শিক্ষকসমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত অসম দুঃখ-কষ্টের করুণ চিত্রের ফসল ‘উত্তরণ’ গল্পটি। গল্পের নায়ক হতদরিদ্র শিক্ষকসমাজের প্রতিনিধি নেয়ামত মাস্টার। সর্বোপরি বলতে হয়, গল্পটিতে সমসাময়িক কালের নিপীড়িত, নির্যাতিত, অবহেলিত ও অত্যাচারিত একজন হতদরিদ্র প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকের জীবন জটিলতার বাস্তব চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।
শুধু বিষয়বৈভবের তরঙ্গপ্রবাহেই নয়; শিল্প প্রকরণের দিক দিয়েও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর আবির্ভাব রাজস্বিক। তিনি বিষয় উপযোগী ভাষা ও রচনারীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে গল্পগুলোকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। তবে গঠন কাঠামোতে কিছু কিছু গল্পের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ন হলেও অধিকাংশ গল্প শিল্পোত্তীর্ণ বটে। গল্পকার ভাব অনুযায়ী ভাষা ব্যবহারের যেমন পারমঙ্গতা দেখিয়েছেন; তেমনই আরবি-ফারসি, হিন্দি ও ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তা ছাড়া ভাষাই সাহিত্যের প্রাণ। ভাষা ব্যবহারে তিনি যেমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন; তেমনই অলঙ্কার প্রয়োগেও রেখেছেন নিপুণতার স্বাক্ষর। বিভিন্ন প্রকার শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার প্রয়োগ করে তিনি গদ্যকে করেছেন শাণিত।
আলোচনা শেষে এ কথা বলা যায়, বাংলাদেশের ছোটগল্পে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অবদান প্রাতিস্বিক। তিনি সমাজবাস্তবতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে পুুঁজি করেই তাঁর ছোটগল্পের বিষয়বৈচিত্র্যের পসরা সাজিয়েছেন। সেইসঙ্গে শিল্পনৈপুণ্যের সমারোহে গল্পগুলোকে করেছেন কালোত্তীর্ণ। বিষয়ভৈবব ও শিল্পগুণের নিক্তিতে তাঁর ছোটগল্পগুলো উচ্চমার্গের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।