কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আমজাদ হোসেনের কৃতি সন্তান কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের গৌরব কবি সাহিত্যিক গবেষক ব্রাহ্মণবাড়িয়র চিনাইর ডিগ্রী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মহিবুর রহিম (৫৫) বুধবার (১৬ জুলাই) রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

বৃহস্পতিবার ১৭ই জুলাই   প্রথম জানাজা তার কর্মস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইর ডিগ্রী কলেজ মাঠে, বিকালে তার গ্রামের বাড়ি ছাতিরচরে বাদ আছর জানাজা শেষে তার নিজ গ্রামে সমাহিত  করা  হবে বলে পরিবার সূত্রে জানা যায় । বেঁচে থাকার সময়ে ডায়বেটিস সহ একাধিক রোগে আক্রান্ত হলেও সদা হাসিখুশি মনের প্রাণোচ্ছল সদালাপী সরল মনের মানুষ ছিলেন তিনি।
কবি মহিবুর রহিমের  হাত ধরে অনেকেই সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও লেখালেখির জগতে পা রেখেছেন। তিনিই প্রথম তার নিজ গ্রামে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে হান্নান গ্রন্থ সুহৃদ  সমিতি ও পাঠাগার নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন ওই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না।  তাঁর নিজ গ্রাম ছাতিরচর তথা হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে তাঁকে ভাবিয়ে তুলতো। তার কথায় ও লেখনির মাধ্যমে হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার চিত্র ফুটে উঠেছে। এই ছাতিরচর গ্রাম কে নদীর ভাঙ্গন থেকে  রোধ করার জন্য তার লেখনীর মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করে সরকারের দৃষ্টি কামনা করা হয়েছে। পুরাতন ছাতিরচরকে একটি মাত্র গ্রাম থেকে  ইউনিয়নে রূপান্তরিত করার পিছনে ছাতিরচর গ্রামের যে সকল ব্যক্তিগন অবদান রেখেছেন তার মধ্যে মহিবুর রহিমও একজন।  এমনকি ৯০ দশকের পর থেকে এই পর্যন্ত ছাতিরচরের যত সব উন্নয়ন হয়েছে এসবের প্রতি ধাপে  ধাপে অন্যান্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি রয়েছে মহিবুর রহিমের নানাবিধ অবদান। সেখানকার পরিবেশ রক্ষা থেকে শুরু করে সৌন্দর্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এবং বৃক্ষরোপণ ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে  রয়েছে যথেষ্ট ভূমিকা।কর্মময় ব্যস্ত জীবনে তিনি এলাকা ছেড়ে দূরে থাকলেও সকল যোগাযোগ ছিলো তার মাতৃভূমির প্রতি।  এলাকার লোকজনের সাথে নিয়মিত ছিলো তার যোগাযোগ বিভিন্ন মাধ্যমে। প্রায়ই তিনি কথা প্রসঙ্গে নদী ভাঙ্গন কবলিত ছাতিরচরের অতীত ইতিহাস তুলে ধরতেন। এমনকি শৈশব স্মৃতি চারণে তাঁকে চোখের জল ঝড়াতেও দেখা গেছে। কিভাবে পৈতৃক  বসতভিটা নদী কেড়ে নিয়েছে, কিভাবে নদী তাদের মতো অসংখ্য পরিবারকে এলাকা ছাড়া করতে বাধ্য করেছে। এমন বাস্তবতা তিনি প্রায়ই তুলে ধরতেন তার কথায়।  তাঁর অসংখ্য লিখনি প্রমাণ করে তিনি কতটা হাওর প্রেমী ছিলেন। কবি আল মাহমুদ,কবি আল আসাদ, কবি আসার দিন হাফিজ, কবি আব্দুল হাই সিকদার সহ অসংখ্য কবি সাহিত্যিকদের একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন।  এছাড়াও তিনি সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা থেকে শুরু করে অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবন ও তাদের কৃতিত্ব তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন লিখনির মাধ্যমে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বন্ধু প্রিয় একজন মানুষ। তাঁর  অসংখ্য গঠনমূলক লেখা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক,সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাষিক  ম্যাগাজিনে স্থান করে নিয়েছে। তার লিখনীর মাধ্যমে বেঁচে থাকার জীবনে নানানভাবে পুরস্কৃতও হয়েছেন। শুধু নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের নন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য অঙ্গনে তাহার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। সারা বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে  ও তার সুনাম রয়েছে। তিনি ছিলেন হাওর অঞ্চলের লেখক ও কবি।  হাওরের বুকে বেড়ে উঠা রাখালদের সাথে সময় কাটানোর সাথে জড়িত করুন ট্রাজেডির সাথে জড়িয়ে থাকা সংগ্রামী কবি সাহিত্যিক মহিবুর রহিম প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে  স্নাতক উত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।  পরবর্তীতে তিনি  প্রিয়জনদের অনুপ্রেরণায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইর ডিগ্রী কলেজে প্রভাষকের চাকরী নেন। সেই সুবাদে সেখানে অবস্থানকালেই তাঁর মৃত্যু হয়। কবি মহিবুর রহিমের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর খবরে তার স্বজন-সঙ্গী ও গুনগ্রাহীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।  মৃত্যুকালে স্ত্রী তিন পুত্র সন্তান এর মধ্যে একজন সন্তান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী,এছাড়াও  ভাই-বোন সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি তাঁর কৃতকর্মে জন্যে নানান লিখনীর মাধ্যমেই গুণগ্রাহীদের মাঝে বেঁচে থাকবেন বলেও স্বজন-সঙ্গীদের অভিমত। সেই সাথে বিদেহী আত্মার মাগফেরাতও কামনা করেছেন।

মহিবুর রহিম নব্বই দশকের খ্যাতিমান কবি ও গবেষক।তিনি বাংলায় একাডেমির একজন স্থায়ী সদস্য ছিলেন।  তার প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু গবেষণা গ্রন্থসহ কয়েকটি কবিতার বই। কবি মহিবুর রহিম  বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্পে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কবি। কবি মহিবুর রহিমের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো (১)   ‘অতিরিক্ত চোখ’, (২) ‘হে অন্ধ তামস’,(৩) ‘অনাবাদি কবিতা’, (৪)‘পলি মাটির অন্তর’,(৫) ‘দু:খগুলো অনাদির বীজপত্র’,(৬) মিলেনিয়াম শব্দজট’,(৭) ‘সবুজ শ্যামল মন’,(৮) ‘শিমুল রোদে রঙিন দিন’ (৯) 
’ ও ‘হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই’।  (১০) হাওর বাংলা। তাঁর রচিত ‘‘ভাটি বাংলার লোকভাষা ও লোক সাহিত্য’ ২০১৯ সালে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন থেকে প্রকাশিত হয়।

কবি মহিবুর রহিমের মৃত্যুতে শোক  জানিয়েছেন, কিশোরগঞ্জ জেলা জামায়াতে ইসলামীর  আমীর অধ্যাপক মোঃ রমজান আলী, কিশোরগঞ্জ সাংবাদিক কল্যাণ পরিষদের সভাপতি শামসুল আলম সেলিম, কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, নিকলী উপজেলা  বিএনপির সভাপতি , এডভোকেট বদরুল মোমেন মিঠু, নিকলী  প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আহসানুল হক জুয়েল, কিশোরগঞ্জ শিখর সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি জহির সাদাত, কিশোরগঞ্জ ফোরাম ঢাকার সভাপতি ড.এম,আব্দুল আজিজ, কবি ও সাহিত্যিক  তাজ ইসলাম প্রমূখ ব্যাক্তিবর্গ।