“চরের মানুষ বলে কি আমরা মানুষ নই? চরের মানুষ হওয়ায় কি আমরা সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবো? আমাদের অপরাধ কী?”

“চরের মানুষ বলে কি আমরা মানুষ নই? চরের মানুষ হওয়ায় কি আমরা সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবো? আমাদের অপরাধ কী?” সাংবাদিক-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন রাজীবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা নাফিউল আজম জুয়েল।

কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন মোহনগঞ্জ। ৯টি ওয়ার্ড ও ১৭টি মৌজা নিয়ে গঠিত এই ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। এখানকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের বসবাস চরে, যেখানে জীবনযাপন কঠিন ও দুঃখ-দুর্দশায় ভরা। নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই শিক্ষার্থীদের খেলার জন্য মাঠও। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা, আর শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল বালুচর পায়ে হেঁটে পার হতে হয়।

এলাকার বাসিন্দারা জানান, যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা-সবক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তরুণ প্রজন্মের। খেলার মাঠের অভাবে তারা সময় কাটাচ্ছে মোবাইল গেম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এদের মধ্যে অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়ায়, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে পারিবারিক অশান্তি ও আর্থিক ক্ষতি।

নাফিউল আজম জুয়েল বলেন, “এখানে খেলাধুলার জন্য একটি মাঠও নেই। তাই তরুণরা বিপথে যাচ্ছে। যদি একটি খেলার মাঠ থাকত, তাহলে তাদের খেলার প্রতি উৎসাহ দেওয়া যেত। আমরা চাই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এখানকার জন্য একটি মাঠ বরাদ্দ দিক, যাতে তরুণরা আলোর পথে ফিরে আসতে পারে।”

স্থানীয় বাসিন্দা মেহেদী হাসান সোহাগ বলেন, “এই এলাকায় ভালো কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, নেই উপজেলা সদরের সঙ্গে কোনো রাস্তার সংযোগ। অধিকাংশ মানুষ জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করেন। তরুণদের খেলাধুলার জন্য কোনো সুযোগ নেই, ফলে তারা মোবাইলে আসক্ত হয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।”

৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জানায়, “আমরা স্কুলে টিফিনের সময় খেলতে পারি না, বিকেলেও কোথাও খেলার জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে মোবাইলেই সময় কাটাতে হয়। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, এখানে যেন অন্তত একটি খেলার মাঠ করা হয়।”

মোহনগঞ্জ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “বর্তমানে যেভাবে স্কুল গুলোতে ভবন নির্মাণ হচ্ছে, তাতে মাঠ রাখার কোনো সুযোগ থাকছে না। একসময় শিশুরা স্কুল মাঠেই খেলত। এখন ভবনের কারণে সেই মাঠও হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়ছে।”

ক্রীড়াবিদ রেজাউল করিম লিটন বলেন, “মাদক, অনলাইন গেম ও জুয়া থেকে তরুণ সমাজকে ফেরাতে চাইলে খেলাধুলার বিকল্প নেই। মোহনগঞ্জে কোনো খেলার মাঠ না থাকায় তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাই সেখানে একটি মাঠ অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।”

রাজীবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে এলাহী বলেন, “যদিও এটি উপজেলা প্রশাসনের সরাসরি দায়িত্ব নয়, তবে যদি কোনো খাস জমি পাওয়া যায়, সেটিকে খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।” অনলাইন জুয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রমাণ পাওয়া কঠিন হলেও, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি এবং প্রয়োজনে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় তা আরও জোরদার করা হবে।”

মোহনগঞ্জে একটি খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠার দাবি এখন সময়ের দাবি। শিশু, কিশোর ও যুবকদের মোবাইল আসক্তি থেকে ফেরাতে এবং তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে খেলাধুলার বিকল্প নেই এটাই বলছেন স্থানীয়রা।