মীর মশাররফ হোসেনের রচনা নিয়ে তাঁর জীবৎকালে যেসব আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলির মূল সুর অনেকটাই এক। কী- না, কোনো মুসলমান যে এমন সুন্দর বাংলা লিখতে জানেন, মীরের গ্রন্থ পাঠের আগে বাংলার হিন্দু তো বটেই, মুসলমান শিক্ষিত সমাজও নাকি এ কথা ভাবতেই পারেনি।

 কাজেই বোঝা মুশকিল যে, এসব আলোচনা কি ব্যক্তি মীর মশাররফের প্রশংসার ছলে তার ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমালোচনা, নাকি তাদের সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেওয়া। কারণ যেটাই হোক, ঘুরে-ফিরে একই ধরনের কথা উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে। কেউ বলেছেন- 'মুসলমানদিগের গ্রন্থ এরূপ বিশুদ্ধ বঙ্গভাষায় অল্পই অনুবাদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।' কেউ লিখেছেন- 'এই যে তিন কোটি মুসলমান, বাঙ্গালা দেশই ইহাদের মাতৃভূমি, বাঙ্গালা ভাষাই ইহাদের মাতৃভাষা। ইহারা যদিও মাতৃভূমি বলিয়া অন্য কোন দেশের উল্লেখ করিতে পারেন না কিন্তু পারসী আরবীই তাহাদের মাতৃভাষা মনে করেন। নিম্রশ্রেণির মুসলমানে কদর্য্য বাঙ্গালায় কথাবার্ত্তা বলিয়া থাকে বটে, কিন্তু শিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলমান বিশুদ্ধ বাঙ্গালায় কথা বলিতে বা বাঙ্গালা চর্চা করিতে একান্ত বিরোধী। তাঁহারা অশুদ্ধ উর্দ্দু ছাড়িয়া ভদ্র বাঙ্গালীর সহিত ভদ্র বাঙ্গালা ভাষায় আলাপ করিতে বড়ই অপমান বোধ করেন, ইহা হিন্দু মুসলমান উভয়ের দুর্ভাগ্যের বিষয়।' আরেক আলোচক লিখেছেন- 'এই দেশের মুসলমানেরা কেহ যে এরূপ বাঙ্গালা ভাষা লিখিতে জানেন আমরা পূর্ব্বে তাহা জানিতাম না।' প্রায় একই ধরনের মন্তব্য আরেক পত্রিকায়- 'গ্রন্থখানি যদিও একজন মুসলমানের লিখিত, কিন্তু ইহার ভাষা কিছুতেই মুসলমানের বলিয়া বিশ্বাস হয় না।

এই গ্রন্থখানি পাঠ করিলে কেবল মুসলমান নয়, হিন্দুগণেরও বিলক্ষণ প্রীতি জন্মিতে পারে।' আবার এই রকম বাংলায় লেখার কারণে নিজ ধর্ম-সম্প্রদায়ের দ্বারা মীর মশাররফ যে তিরস্কৃত হয়েছিলেন, সে কথা তিনি নিজেই লিখেছেন- 'বিষাদ-সিন্ধুর প্রথম ভাগেই স্বজাতীয় মূর্খদল হাড়ে-হাড়ে চটিয়া রহিয়াছেন। অপরাধ আর কিছুই নহে, পয়গম্বর এবং ইমামদিগের নামের পূর্বে বাংলা ভাষায় ব্যবহার্য শব্দে সম্বোধন করা হইয়াছে।' মোট কথা, 'বিষাদ সিন্ধু'র মাধ্যমে মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যের জগতে একটি আলোড়নই তুলে ফেলেছিলেন। আজকের ভাষায় আমরা বলতে পারি, বিষাদ সিন্ধুর আবির্ভাব ছিল সত্যিকারেরই একটি 'ঘটনা'। তবে ঘটনাটা এমন ছিল না যে মীর মশাররফ 'এলেন দেখলেন জয় করলেন'। বিষাদ সিন্ধুর আগে রয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতির ইতিহাস, দীর্ঘ পথচলার ইতিহাস, উত্থান এবং পতনের ইতিহাস, রক্তাক্ত হবার এবং স্বেদাক্ত হবার ধারাবাহিকতা। সকল কবি-সাহিত্যিককেই হৃদয় এবং পদতলের জখম নিয়েও যে পথ পাড়ি দিতেই হয়। তবে এটি প্রশ্ন হিসাবে সত্যিকারেরই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে যে, বাংলায় তথাকথিত 'ক্ষয়িষ্ণু আশরাফ মুসলমান' ঘরে জন্ম নিয়ে মীর মশাররফ কীভাবে বাংলাচর্চায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। উদাহরণ তো আরো রয়েছে। যেমন বেগম রোকেয়া। কিন্তু এখানে আমাদের আলোচ্য- মীর মশাররফ। সেই মীর অশুদ্ধ উর্দুর পরিবর্তে কোন দৈববলে বাংলাচর্চায় ব্রতী হলেন? উত্তর কিছুটা পাওয়া যায় তাঁর 'আমার জীবনী'তে। দেখা যাচ্ছে, লৌকিক বাংলার রীতি-প্রথা তখন তাদের পরিবারে ঢুকে পড়েছে। জন্মমুহূর্তে শিশুর কানে আজানের বাণী এবং সুর দেওয়া হচ্ছে মুসলিম রীতি অনুসারে। আবার শিশুর শিয়রে রাখা হচ্ছে ভালো কলম, দোয়াত, কালি, সাদা কাগজ, পেন্সিল কাটার ছুরি, ঢোল, তবলা, সেতার, বেহালা, তাস, পাশা, দাবা, লাঠি, সড়কি, তলোয়ার। শিশু যাতে বড় হয়ে সর্ববিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে; একই সাথে সমর্থবান এবং বীর যোদ্ধাও হয়ে ওঠে- সেই কামনায় শিশুর শিয়রে এসব জিনিসের যুগপৎ সহাবস্থান। আরো একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে 'আমার জীবনী' থেকে।

সেটি হচ্ছে ১৮৭২ সালের আদমশুমারির আগ পর্যন্ত বাংলায় যে হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা সমান সমান, সেটি কেন জানতেন না বাংলার হিন্দু-মুসলমান কোনো নেতাই। ওই আদমশুমারির আগে নাম দেখে হিন্দু-মুসলমান আলাদাভাবে শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। মুসলমানদের নাম রাখা হতো গোবরা, পচা, পরাণ, কালো। এমনকি মুসলমান বালকের ডাকনাম থাকত নন্দ, গৌর, কালাচাঁদ, হরিজন। ভালো নাম মখদুম হলেও ডাকনাম হয়ে যেত মদন। লেখাপড়া জানা মুসলমান হয়তো আদমশুমারির সময় নিজের শুদ্ধ নামটি লেখাতেন, কিন্তু অশিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের ডাকনাম লিখিয়েই সন্তুষ্ট থাকত। মুসলমানের হিন্দুয়ানি নামের ধারাবাহিকতায় মীর মশাররফ হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী কুলসুমের নাম ছিল কালী, আর কুলসুমের মায়ের নাম লালন। আবার নিজে এই প্রবণতার সমালোচনা করেও মীর মশাররফ নিজের ডাকনামের ক্ষেত্রে এই একই রীতি মেনে চলেছেন। কন্যা রওশন আরার ডাকনাম ছিল সতী। পুত্র ইব্রাহীম হোসেন হন সত্যবান, আমিনা খাতুন- কুকি, যমজ দুই বোন ছালেহা এবং সালেমা হয় সুনীতী ও সুমতী, আশরাফ হোসেন হয় রণজিত, ওমর দরাজ হয় সুধন্ব, আর মীর মাহবুব হোসেন হয় ধর্মরাজ। শহরে পড়াশুনা করতে এসে পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্য তাকে আর কী কী করতে হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ আছে একই গ্রন্থে- 'কলেজে ভর্তি হইলাম।

কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে। কৃষ্ণনগরের চাল-চলন দেখাদেখি ক্রমে আমার স্বভাবের উপর আধিপত্য করিতে লাগিল। দশজনের আচার-ব্যবহারই আমার অনুকরণীয় হইল। কৃষ্ণনগরে মুসলমানের গৌরবমাত্র নাই। হিন্দুপ্রধান দেশ। ধূতি পরিতে শিখিলাম। চাদর বা উড়ানী গায়ে দেওয়া অভ্যাস হইল। মাথার চুল ছাঁটিয়া ফ্যাশনেবল করিলাম। হায় হায়! বাউরী চুল কাটিয়া থাক থাক করিলাম। পিছনের দিকে কিছুই নাই। সম্মুখভাগ সিতীকাটার উপযুক্ত মত থাকিল। পাজামা চাপকান বাড়ী পাঠাইয়া দিলাম। টুপিটাও ক'দিন পর সহপাঠীরা আগুনে পোড়াইয়া ফেলিল।... পরণ-পরিচ্ছদও হিন্দুয়ানী। চালচলন হিন্দুয়ানী, কান্নাকাটি হিন্দুয়ানী। মুসলমানের নামও হিন্দুয়ানী, যথা, সামসদ্দীন- সতীশ, নাজমুল হক- নজু, বোরহান- বীরু।' সাংবাদিকতা ও সম্পাদনাকর্মও তাকে অনেকখানিই সহায়তা করেছে। ১৮৭৪ সালে 'আজিজন নাহার' পত্রিকার সম্পাদনা যে তার লেখার পক্ষে কল্যাণকর হয়েছিল, সে কথা তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়াও বিষাদ সিন্ধু লেখার আগেই লিখে ফেলেছিলেন তিনি অনেক গদ্য-পদ্য-নাটক-প্রহসন। বিষাদ সিন্ধু প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৮