গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন (জিসিসি) নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আর মাত্র ১০ দিন বাকি। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে পাশা পাশি নির্বাচনী উত্তাপ ততোই বেড়ে চলছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রার্থী, কর্মী ও সমর্থকদের ব্যস্ততা ও অস্থিরতা। এবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা প্রতিদিন সকাল হতে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়, দোকানপাট, কলকারখানায় ও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিয়ে গণসংযোগ করেছেন এবং প্রচারপত্র বিতরণ করে ভোট চাচ্ছেন। ফাঁকে ফাঁকে তারা গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পথসভা ও বৈঠক করছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ভোট চাচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীদের গণসংযোগে যোগ দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। বসে নেই এ নির্বাচনের কোন প্রার্থী। তারা সিটি কর্পোরেশনের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ভোটারদের খোঁজে ছুটে যাচ্ছেন বাড়ি বাড়ি, অফিস ও মিল কারখানায়। নানা কৌশলে তারা নির্বাচনী পুরো এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকদের পদচারণায় গাজীপুর মহানগরীর পুরো এলাকা এখন মুখরিত হয়ে উঠেছে।
নির্বাচনের আমেজ ও উত্তাপ নগরীর সীমানা ছেড়ে আশেপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিকে এসে প্রার্থীরা তাদের বিভিন্ন কৌশলকে কাজে লাগিয়ে ছুটছেন বিভিন্ন এলাকায় ভোট প্রার্থনা করতে। সবার মূল দৃষ্টি এখন মেয়র প্রার্থীদের দিকে। এ নির্বাচনে কে হচ্ছেন পরবর্তী নগর পিতা, কার গলায় ঝুলবে বিজয়ের মালা। এ দিকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করতে কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে দিনরাত কাজ করছেন রিটার্ণিং অফিসার ফরিদুল ইসলাম। গত রবিবার জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক সভা করেছেন রিটার্ণিং কর্মকর্তা। এদিন থেকে শুরু হয়েছে ভোট গ্রহণের কাজে কেন্দ্রে দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের প্রশিক্ষণ। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন। তারা মেয়র পদে দলের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এড. আজমত উল্লা খানকে বিজয়ী করতে জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় জোরে শোরে কাজ শুরু করেছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে নানা হিসেব নিকেষ করে তারা নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
গত রবিবার দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের কর্মী সমর্থকদের নিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সকাল হতে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছেন। এদিন ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনও আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। অপর দিকে সমান ভাবে পাল্লা দিয়ে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের মা টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন দিনভর নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। মাকে বিজয়ী করতে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর নিজেদের কর্মী সমর্থকদের নিয়ে প্রার্থীর পক্ষে কর্মকৌশল তৈরী করে প্রতিদিন মাঠে নামছেন। প্রার্থীদের গণসংযোগ ॥ আওয়ামীলীগ ॥ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী (নৌকা) এড. আজমত উল্লা খান সকাল হতে দলের নেতা কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে পূবাইল থানার হারবাইদ, মেঘডুবি, মীরের বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। এসব গণসংযোগে ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনসহ দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা অংশ নেন। দিনভর এ প্রচারণায় দলের নেতা কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণের শিক্ষক কর্মচারী, মসজিদের ইমাম এবং সাধারণ ভোটারগণ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে যোগ দেন। গণসংযোগকালে তিনি একাধিক স্থানে অনুষ্ঠিত পথসভায় বক্তব্য দেন।
এ সময় তিনি বলেন, গাজীপুরে নৌকার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে ও নগরীর উন্নয়নের স্বার্থে আগামী ২৫ মের নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাকে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানান। স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন । টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মেয়র পদে প্রতিদন্ধিতা করছেন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। রবিবারেও তিনি ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরকে সঙ্গে নিয়ে নগরীর জজ কোর্ট এলাকা হতে গণসংযোগ শুরু করেন। পরে তিনি সদর থানার জয়দেবপুর, শিমুলতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। জাপা প্রার্থী জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন (লাঙ্গল) গত রবিবার মহানগরীর সাতাইশ, নৈপাড়া, বড়দেওড়া, মিলগেটসহ টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় দিনভর কর্মী সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগ করেন। এসময় তিনি একাধিক পথসভায় বক্তব্য রাখেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি ॥ এদিকে হাতি প্রতীক নিয়ে অপর স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি এদিন সকাল হতে টঙ্গী পাগাড় এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেন। দুপুর পর্যন্ত তিনি কর্মী সমর্থকদের নিয়ে টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। বিকেলে শিমুলতলি ও জয়দেবপুরসহ সদর থানার বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র প্রার্থী ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান (হাত পাখা) কর্মী সমর্থকদের নিয়ে নগরীর টঙ্গী পূর্ব ও টঙ্গী পশ্চিম থানার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ও এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। এ সময় তিনি একাধিক পথসভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি নগরীর বিভিন্ন সমস্যা দুর করে নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ ॥ রিটার্ণিং অফিসার ফরিদুল ইসলাম জানান, নির্বাচন সুষ্ঠু ও সফল করার জন্য প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে রবিবার। এরমধ্যে প্রায় ৫শ’ জন রয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসার, প্রায় ৪হাজার জন সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার ও ৮হাজার জন পোলিং অফিসার রয়েছেন। তবে এখনও তালিকা চূড়ান্ত হয় নি। একাধিক ব্যাচে এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২১ মে পর্যন্ত। রবিবার এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম। এরপর আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। এছাড়াও জিএমপি কমিশনার কার্যালয়ে অপর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনঃ জাহাঙ্গীরের মায়ের তিন সমর্থকের লাখ টাকা অর্থদন্ড, মোটরসাইকেল জব্দ ॥ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের তিন সমর্থককে নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এসময় দু’টি মোটরসাইকেল জব্দ ও একটিকে আরো ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। শনিবার সন্ধ্যায় মহানগরীর পূবাইল কলেজ গেইট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নির্বাচনে আচরণ বিধি সংক্রান্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিক এ অর্থদন্ড করেন। জিএমপি’র পূবাইল থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম জানান, শনিবার সন্ধ্যায় নির্বাচনী আচরণ বিধি ভঙ্গ করে কয়েকশ’ মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাসহ স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন তার নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচনে আচরণ বিধি সংক্রান্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের উপস্থিতিতে মহানগরীর পূবাইল কলেজ গেইট এলাকায় স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের গাড়ির বহরকে থামানো হয়।
এ সময় তার সঙ্গে গাড়ীতে তার ছেলে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন। তাদের বহনকারী গাড়ীর সামনে ও পিছনে ৩/৪ শ’ মোটরসাইকেল ছিল। পরে জায়েদা খাতুনের পক্ষে সেখানে উপস্থিত জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি তার মা ও চালকসহ চারজন তার মায়ের টেবিল ঘড়ি প্রতীকের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছেন। পথে আশেপাশের এলাকা থেকে অন্যান্য মোটরসাইকেল তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তাদের কাউকে তিনি বা তার মা আনেননি। এ বক্তব্য শোনার পর দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাদেরকে সতর্ক করে জাহাঙ্গীর আলম ও তার মাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। পরে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে নির্বাচনী প্রচারণায় মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে অংশগ্রহণকারী জায়েদা খাতুনের তিন সমর্থকের দুইজনকে ৩০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকা এবং একজনকে ৪০ হাজার টাকা সহ মোট এক লাখ টাকা অর্থদন্ড করেন। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিক জানান, এ অবস্থায় প্রার্থীকে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের ব্যাপারে প্রথমবারের মতো সতর্ক করা হয়। তারা চলে গেলে মোটর শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী টেবিল ঘড়ি প্রতীকের সমর্থক তিনজনকে আর্থিক জরিমানা করা হয়।
তাদের দু’জনকে ৩০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকা ও একজনকে ৪০ হাজার টাকাসহ মোট এক লাখ টাকা অর্থদন্ড করা হয়। তিনি আরো জানান, এ সময় দু’টি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয় ও একটি মোটরসাইকেলের মালিককে ৫হাজার টাকা অর্থদন্ড করা হয়। টেবিল ঘড়ি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন বলেন, আমার নির্বাচনী প্রচারনাকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। শনিবার সন্ধ্যায় নির্বাচনী গণসংযোগ চলাকালে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে মহানগরীর পূবাইল কলেজ গেট এলাকায় আমার গাড়িকে থামানো হয়। ওইদিন একজন প্রার্থী হিসেবে আমি আমার ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও গাড়ির চালকসহ মোট চারজন একটি গাড়িতে চড়ে নির্বাচনে প্রচারণায় বাসা থেকে বের হই। পথে আশেপাশের এলাকা থেকে অন্যান্য লোকজন মোটরসাইকেল নিয়ে যুক্ত হয়েছে। মোটর শোভাযাত্রায় যারা এসেছে তাদের কাউকে আমরা আনি নি।
তারা এমনিতেই এসেছে। অথচ পুলিশ আমাদেরকে প্রায় দুই ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এতে নির্বাচনী কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে। এছাড়াও তারা আমার গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গেছে, মাইক ছিনিয়ে নিয়েছে। অথচ পরদিন রবিবার আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী একই থানা পূবাইল এলাকায় কয়েকশ’ মোটর সাইকেল নিয়ে শো’ডাউন করে মিছিল করেছে, সেই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় নাই। আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে মেয়র পদে ৮জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। এছাড়াও ১৯টি সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর আসনে ৭৮ জন এবং ৫৭টি ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর পদের ২৪৩ জন সহ মোট মোট ৩২৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন।